ইউটিউব ও টিভি চ্যানেলে লোভনীয় বিজ্ঞাপন, ভয়ভীতি আর আধ্যাত্মিকতার নামে সর্বস্বান্ত অসংখ্য মানুষ; পিবিআইয়ের জালে প্রতারক চক্রের ৩ সদস্য

বিশেষ প্রতিনিধি:

‘সুপার ন্যাচারাল’ ক্ষমতার ফাঁদে ফেলে গৃহবধূ জ্বীনের বাদশা তান্ত্রিক, শাস্ত্রিক জৈনপুরী মা ফাতেমার দরবারে সকল সমস্যার সমাধানের নামে প্রকাশ্যে ইউটিউব চ্যানেলে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় প্রতারক চক্রের ০৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। গত ১৮ মে ২০২৫ খ্রিঃ তারিখে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন— মোঃ রাকিব (২০), মোঃ রাকিব মোল্লা (২৯), মোঃ আলাউদ্দিন।

এক গৃহবধূর সর্বস্বান্ত হওয়ার কাহিনি

ঢাকার তেজগাঁও তেজকুনীপাড়ার গৃহবধূ রহিমা বেগম (৩৪) এর সৌদি প্রবাসী স্বামী ১৭ জন বাংলাদেশীর ভিসার জন্য ৩৫,০০,০০০/-(পঁয়ত্রিশ লক্ষ) টাকা কফিলকে দিয়ে ভিসাও পায়নি এবং টাকাও না পেয়ে যখন দিশেহারা তখনই উক্ত গৃহবধূ ‘জ্বীনের বাদশা’ ও ‘মা ফাতেমার দরবারে’ সকল সমস্যার সমাধানের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারক চক্রের মিথ্যে নাটক ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ১০,২০,০০০/-(দশ লক্ষ বিশ হাজার) টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন। এই ঘটনার পর তিনি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানার মামলা নং-১৬, তারিখ: ২২/০৪/২০২৪ খ্রিঃ, ধারা: ৪০৬/৪২০/৫০৬/৩৪ পেনাল কোডে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) স্ব-উদ্যোগে অধিগ্রহণ করে এবং বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত শুরু করে। পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোঃ মোস্তফা কামালের তত্ত্বাবধান, পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর ইউনিট ইনচার্জ অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান, পিপিএম-সেবা এঁর সার্বিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিরস্ত্র) মোঃ সিরাজ উদ্দিন মামলাটি তদন্ত করেন।

ঢাকা থেকে ভোলা পর্যন্ত অভিযান

তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিরস্ত্র) মোঃ সিরাজ উদ্দিন এর নেতৃত্বে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর অভিযানিক টীম তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার সাথে জড়িত আসামীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। সর্বশেষ ১৮ মে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভোলা জেলার ভোলা সদর, লালমোহন, তজুমুদ্দিন, বোরহানউদ্দিন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আসামী ১। মোঃ রাকিব (২০), ২। মোঃ রাকিব মোল্লা (২৯), ৩। মোঃ আলাউদ্দিন (২৬), সর্ব সাং-ফুলকাচিয়া, বোরহানউদ্দিন, ভোলাগণকে নিজ বাড়ি এবং চৌমুহনী বাজার থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামীরা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে।

জব্দ মোবাইল, ভিডিও ও ভয়েস রেকর্ড

গ্রেফতারকৃত আসামীদের দেওয়া তথ্যমতে তাদের হেফাজত হতে ০৪টি মোবাইল, ০৩ টি লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ভিডিও, আসামীদের সাথে বিভিন্ন ভিকটিমের কথা বলার ভয়েস রেকর্ড ১০টি, ০৭টি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবি জব্দ করা হয়েছে।

লাখ নয়, কোটি টাকার প্রতারণা

মামলার বাদীর দাবীকৃত ১০,২০,০০০/-(দশ লক্ষ বিশ হাজার) টাকা প্রতারকের খপ্পরে পড়ে নেয়ার কথা উল্লেখ করলেও মামলা তদন্তকালে ও গ্রেফতারকৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসামীরা প্রকাশ্যে ইউটিউব চ্যানেলে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাজার হাজার লোককে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদ

মানুষকে প্রলুব্ধ ও আকর্ষণ করার জন্য ‘জ্বীনের বাদশা’ খ্যাত প্রতারক চক্র বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দাবী করে— সবকিছুর সমাধানকারী আল্লাহতাআলা, মানুষ উছিলা মাত্র। বর্তমান বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপমহাদেশের তান্ত্রিক, শাস্ত্রিক এবং জ্বীন সাধন বিদ্যায় অভিজ্ঞ জৈনপুরী মা ফাতেমা, যিনি পবিত্র শবেবরাতের রাতে স্বপ্নযোগে আধ্যাতিক ক্ষমতাবলে ‘সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার’ অর্জন করে, জ্বীন ও পরী সাধন করে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে থাকেন। মা ফাতেমা মুখ দেখেই মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বলে দিতে পারেন। তাঁর তদবীর নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেকেই লটারী জিতেছেন, মনের মানুষকে ফিরে পেয়েছেন, চাকুরীতে প্রমোশন পেয়েছেন ইত্যাদি।

প্রতারণার কৌশল ও গল্প

আসামীরা কৌশলে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সব সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখায়। বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হয়ে তাদের দেয়া নম্বরে বাদী রহিমা বেগম ফোন করলে তারা জানান, সৌদি কফিলকে বাধ্য করার জন্য আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কাপ সিন্দুর লাগবে। পরে বলা হয়, জ্বীন পরীকে পাক পবিত্র করতে ভূটানী গরুর ২১ কেজি দুধ দরকার। বাদীকে রত্নময়ী শ্রী আংটি পরতে হবে, যা জ্বীনেরা পৌঁছে দেবে— এর জন্য ‘জ্বীনদের মিষ্টি খাওয়ানোর টাকা’ দিতে হবে। পরবর্তীতে বলা হয়, খবিশ জ্বীনেরা পথ আটকে দিয়েছে, তাদের ছাড়াতে পাঠা বলি দিতে হবে। এভাবেই ধাপে ধাপে প্রতারণা চলতে থাকে।

ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়

হতাশাগ্রস্ত লোকদের প্রতারণায় বাধ্য করতে না শুনলে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করা বিভৎস ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো হতো। বলা হতো, কথা বললে সন্তানের মুখ দিয়ে রক্তবমি হবে, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি হবে। প্রতারণার অংশ হিসেবে ‘মা ফাতেমা’ নারী কণ্ঠে ভয়েজ দিয়ে এবং ‘জ্বীনের বাদশা’র ভয়েস দিয়ে পুরুষ প্রতারক কথা বলত।

এ কাজে অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা ভুয়া সীম ব্যবহার করে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করা হতো। তদন্তে বিকাশ স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আসামী ১। মোঃ রাকিব (২০), ২। মোঃ রাকিব মোল্লা (২৯), ৩। মোঃ আলাউদ্দিন (২৬), সকলেই বোরহানউদ্দিন, ভোলার। বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করলে মো. রাকিব ও মো. রাকিব মোল্লা ফৌজদারী কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে। মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে।